শুক্রবার, ২২ এপ্রিল, ২০১১

ইহা একটি ভালবাসার গল্প



আমরা কখনো করি নি শীৎকার
সঙ্গম আশ্লেষে
আমাদের প্রেম প্রতিজ্ঞা কেবলই
দীর্ঘশ্বাসে মেশে...


ডার্ক-১
তখন তারা মৈথুনে। অভ্যন্তরে সত্তুর ভাগ জল, তারা স্নানশীল সেই নোনাতরলে, যেন সমুদ্র ঢেউয়ে অবগাহন, প্রগাঢ়, মুগ্ধ ও বৃষ্টি-সম্ভাবনার। দূরের মহাসড়কে তখনই বাস বা ট্রাকের চাকা হয়তো বার্স্ট হয়, বা কোথাও বোমা ফাটে, বা কেউ গুলি করে; বিকট একটা শব্দ রাতের নিরবতাকে ছিঁড়ে কাঁপতে কাঁপতে এ পর্যন্ত চলে আসে। রাত জাগা কী একটা পাখি বাদুর বা পেঁচা উড়ে যায়; কলাগাছের পাতা কাঁপে। কিন্তু তারা এসব টেরও পায় না। ক্রমে তারা ডুবে যায়, ডুবতে থাকে; তাদের পাতালমুখি অভিযান একাগ্রচিত্ত। অথচ মণ্ডলবাড়ির উঠোনে চার পা ছড়িয়ে শুয়ে থাকা নেড়ি কুত্তাটা জেগে ওঠে; এদিক ওদিক চায় , এক দুবার ঘেউ ঘেউ করে, তারপর আবার যেভাবে শুয়ে ছিল সেভাবেই চার পা ছড়িয়ে দেয়।
কলাগাছের ওপাশে আঁধারটা যেখানে আরো ঘন হয়ে আরো একটু আড়াল তৈরি করে, সেখান থেকে ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক ছাপিয়ে কিছু শব্দ উচ্চকিত হয়। তার সঙ্গে সাপের ফোঁসফোঁসের বা বেজির হিসহিসের কিংবা মানুষের শীৎকার আশ্লেষের ধ্বনিগত মিল থাকলেও থাকতে পারে।

ডার্ক-২
ঘাস খাওয়ার সময় গরুগুলিকে মনে হয় শান্ত। গায়ের উপর শালিক বা ফিঙে এসে বসলেও কিছু বলে না; দু একবার লেজ নাড়ায়, এবং সেটাও যে শালিক বা ফিঙে তাড়াবার জন্যে তা মনে হয় না, মনে হয় যেন আদর করে। জুবেরী ভবনের মাঠে যে গরুগুলো ঘাস খায়, তাদের ঘাড়ের উপর শালিক বসে বিশ্রাম করে। তখন জুবেরী ভবন রোদরোদ্দুররোদেলায় চোখের পাতার মতন কাঁপে। চারদিকে ছড়িয়ে থাকে ঘন নির্জনতা। এই নির্জনতা ভেঙে দেয় রিকশাঅলাটির বেলের টুংটাং শব্দ। জুবেরী ভবনের পাশ দিয়ে প্যারিস রোড কাজলা গিয়ে মেশে। রিকশাঅলাটি প্যারিস রোড ধরে রিকশার বেল বাজাতে বাজাতে চলে যায়। আর প্যারিস রোডের পাশেই যে জায়গাটা ভাঁটফুলে জংলা হয়ে থাকে, সেখানে হয়তো একটা সাপ ব্যাঙ গেলার চেষ্টা করে। রিকশাঅলাটি বেল না বাজালে সে-ও হয়তো শুনতে পেত সাপের মুখে ব্যাঙ যন্ত্রণায় কো কো করে। অথচ তারও কাছে বাউন্ডারিওয়াল লাগোয়া ছাতিম গাছের নিচে বসে থাকে যে একজোড়া তরুণ-তরুণী তারা ব্যাঙের কান্না শুনতে পায় না। তখন তারা বোধলুপ্ত হয়, কেননা তাদের দুটো শরীর একটা ছায়া তৈরি করে। মিশে যেতে যেতে তখন হয়তো তরুণটির ভেতরে জ্বলে ওঠে আগুন আর তরুণীটি মোম হয়ে যায়। আগুনের উত্তাপে মোম তো গলবেই।

ফোকাস-১
লোকটাকে দেখে জেলে মনে হবে না। কিন্তু সে জাল নিয়ে মাছ ধরতে আসে। দ্বারিয়াপুর বিলের মাঝখানে পানি নিষ্কাশন খালে তখন হয়তো পানি তেমন থাকে না। অল্প পানিতে কিইবা আর মাছ থাকবে! তবু লোকটার হয়তো অন্য কোন কাজ থাকে না, বা যাই হোক কিছু মাছ ধরে অন্য কাজে যেতে চায়; বা লোকটা হয়তো ভাবে একবেলার মাছ হয়ে গেলেও কিছু টাকা তো অন্তত বাঁচবে! সে যখন মাছ ধরতে আসে তখনও কিছু অন্ধকার ছড়িয়ে থাকে ক্যানেলের আশপাশটায়। তারপর রঙের ক্রান্তিকালে, রাতের মধ্যে দিন এসে পড়লে যে অপার্থিব আলোর সৃষ্টি হয়, সেই প্রপঞ্চ আলোয় লোকটা কিছু একটা দেখে। আরো একটু এগোলে সে আবিষ্কার করে ঘাসের উপর ফুটফুটে নবজাতক শুয়ে থাকে। তখনও হয়তো শিশুটির মধ্যে ছোট প্রাণ ধুকপুক করে। এই ধুকপুকানি লোকটির মধ্যেও ছড়িয়ে পড়লে সে সকালে তার আর মাছ ধরা হয় না। সে বাড়ি ফিরে যায়। ফেরার পথে গ্রামের দিক থেকে আসা সম্মিলিত একটা কান্নার ধ্বনি তার চলার গতিকে দ্রুতগামী করে।
হাফিজউদ্দিন মোড়লের বড় মেয়ে সুলতানা সেই সকালে আত্মহত্যা করে, এই খবর সকাল সাতটার মধ্যেই রাষ্ট্র হয়ে যায়।

ফোকাস-২
ক্লিনিক। ওষুধ ওষুধ গন্ধ চারদিকে। সে বসেছিল প্লাস্টিকের একটি মোড়ায়। এই ক্লিনিকের নাম মুক্তি ক্লিনিক। তার মনে হয়, মেয়েদের আপদ থেকে মুক্ত করে বলেই হয়তো এর নাম মুক্তি ক্লিনিক, বা সে ভাবে, মানুষ শুধু নিজেরটাই দেখে; এমনও হতে পারে, ক্লিনিকের মালিকের ছেলে বা মেয়ের নামে হয়তো এর নামকরণ করা হয়। তখন শাদা পোশাক অল্পবয়সী নার্স মেয়েটি এসে তাকে বলে- আপা আসেন।
তারও ঘণ্টা দুয়েক পরে সে যখন ক্লিনিক থেকে বেরোয়, তখন নিজেকে হয়তো তার মুক্ত মনে হয়; কিন্তু হাঁটতে গিয়ে বোঝে দুর্বলতা কাটতে আরো কিছু সময় প্রয়োজন।

ডার্ক-৩
সূর্য অনেকক্ষণ আগেই হয়তো ডুবে যায়; কেননা রাস্তার বাতিগুলো জ্বলে ওঠে। তারা বাতি রাস্তায় হাঁটে না। তৃতীয় বিজ্ঞানভবনের পাশ দিয়ে যে রাস্তাটা বোটানিক্যালের দিকে চলে যায়, সেই অন্ধকার রাস্তায় তারা ঘনিষ্ট হয়; কতটা নিবিড় অন্ধকারে বুঝা যায় না। কিন্তু ছেলেটির হাত জার্নি শুরু করলে মেয়েটি হেসে দূরে যায়। যাঃ
অতঃপর মেয়েটি তার পার্সের চেইন খোলে।
তুঁতবাগানের পাশে জুয়োলজি ডিপার্টমেন্টের পুকুরে পানি অনেক। তবুও এ পুকুরে কোনদিন কাউকে গোসল করতে দেখা যায় নি। এখানে বিদেশের উন্নতমানের চিতাদের বা রাজাদের ভেসে বেড়াতে দেখা যায়।








বৃহস্পতিবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০১০

পুরোনো দিনের গল্প





একাশি বাই এ পূর্ব নাখালপাড়ার পলেস্তরা খসা বিল্ডিংয়ের দোতলা ঘরে একদিন মতিউর রহমান সাগরের সঙ্গে বসে চা খাওয়ার মুহূর্তটিতে অবধারিত হয়ে যায় যে কিছুদিন পরে সৈয়দ আমীর আলী হলের থ্রি নট সেভেনে এক দিবাগত সন্ধ্যায় আমার সঙ্গে শফিক আশরাফের দেখা হবে। শফিক আশরাফের তর্জনী ও বুড়ো আঙুলের মাঝখানে অনেকখানি কাটা দাগ, হাত মেলাতে গিয়ে বুঝি বুড়ো আঙুলটা কুঁচকে চিকন হয়ে গেছে; আমি চোখ নামিয়ে আঙুলটাকে দেখি, তখন শফিক আশরাফ আমাকে বলে চাক্কুর কোপ খাইছিলাম। আমি আড়চোখে উত্তমের দিকে তাকাই, ওকে বোঝাতে চাই যে এ কার কাছে নিয়ে এলে! আমার কাশমেট উত্তম এর আগে একজন গল্পকারের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবে বলে আমাকে এখানে নিয়ে আসে; কিন্তু চাক্কু প্রসঙ্গে আমার এক ধরনের ভীতি হয়, তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরের গাজীরা যেভাবে দাপটে হাঁটে ও তাণ্ডব দেখিয়ে বেড়ায় তাতে এমনিতেই ক্যাম্পাসে আতঙ্ক ও গুমোট একটা আবহাওয়া বিরাজমান থাকে; শফিক আশরাফ আমাকে কিভাবে বোঝে জানি না, বলে, আরে না, বাড়ীতে আম কাটতে গিয়ে কেটে গেছিল; বলে তোমার লেখা পড়লাম সাপ্তাহিকে, ভাল লাগল, তোমারে তাই খুঁজতেছিলাম, উত্তমরে বলছিলাম তোমার কথা, ও বলল তোমরা নাকি এক সাথে পড়, ওকে বলছিলাম তোমারে নিয়ে আসতে; আমি বিহ্বল হই, আমার লেখা! ভুলে গেছিলাম যে, একাশি বাই এ পূর্ব নাখালপাড়ার পলেস্তরা খসা বিল্ডিংয়ের দোতলা ঘরে বন্ধু মতিউর রহমান সাগরের সঙ্গে বসে চা খেতে খেতে ইসমাত আরা খাতুনকে নিয়ে একটা ছোট লেখার কথা ভেবেছিলাম, পরে লিখে একটা সাপ্তাহিকে পাঠানো হয়েছিল, সেই লেখা পড়ে কেউ আমাকে খুঁজতে পারে ভাবি নি। কিন্তু এভাবে ইসমাত আরা খাতুন তার অজান্তে শফিক আশরাফের সঙ্গে আমাকে ওতপ্রোত করে দেয়; তবে এই সংলগ্নতা যে শফিক আশরাফের ব্যক্তিজগতের অনুভব-বৃত্তের বাইরে নিয়ে গিয়ে ক্রমে অবাধ ও নৈর্ব্যক্তিক করে দেবে সেরকম ভাববার দর্শিতা তখনও আমার ছিল না।
তাই হয়। শফিক আশরাফ আমাকে পদ্মাপাড়ে নিয়ে যায়; হেমন্তের ধানখেতের মত লেপ্টে থাকা পদ্মা নদী, দিগন্তে অবতরণশীল আকাশ দেখে দেখে ততদিনে শফিক ভাই হয়ে উঠা শফিক আশরাফ ভরা গলায় কাজী নজরুলের গান গায়, শূন্য হৃদয়পদ্ম নিয়ে যাবার আকুতিটা তার গলায় ঠিকমতো আসে না কিন্তু মনের ভেতরকার আবেগটুকু বুঝতে পারা যায়। চাঁদরাতে আমরা সৈয়দ আমীর আলী হলের পেছনের রাস্তাটা ধরে বুধপাড়ায় সুইপারদের কলোনীতে চলে যাই; সুইপার কলোনীতে গিয়ে বুঝি একটা জীবন মানুষ কত মানবেতরভাবে যাপন করতে পারে! তারপর যখন আবার আমীর আলীর মাঠে ফিরে ব্যাডমিন্টন কোর্ট ফুঁড়ে জেগে ওঠা ঘাসে পা ছড়িয়ে বসে আড্ডায় মাতি তখন জীবনের এই বৈপুল্য নিয়ে আমাদের কথা হয়; আরও কতকিছু নিয়ে যে আমরা কথা বলি তার কোন হিসেব থাকে না। শামীম নওরোজকে নিয়েও কথা হয়, বস্তুত কবি শামীম নওরোজ আমাদের কথাবার্তার পুরোভাগে অদৃশ্য সঞ্চালকের ভূমিকা পালন করে। কিন্তু তার সঙ্গে দেখা হয় না; তিনি তখন ঢাকায় অন্যকাজে ব্যস্ত। এই ফাঁকে ফারুক আকন্দের সঙ্গে ঠিকই দেখা হয়ে যায়। শেরে বাংলা হলের গ্রাউন্ড থার্টিনে তার রুমে ইলিয়াসের দোযখের ওম হাতে ফারুক আকন্দের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়; শফিক ভাই তার এই বন্ধুটিকে পরিচয় করিয়ে দেয় এভাবেÑআমার দোস্ত গান্জাখোর ফারুক; শুনে ফারুক আকন্দ হাহা করে হাসে, বলে ধুস শালা খালি গানজাই খাই নাকি লিকুয়িডও খাই! খাটের নিচ থেকে রয়াল স্ট্যাগের অনেকগুলো খালি বোতল বের করে এনে বলে দ্যাখ শালা, তখন আমরা তিনজনই সশব্দে হেসে উঠি। এভাবে খুব প্রথম দিনে ফারুক আকন্দের সঙ্গে আমার জমে যায়; বিকেলে প্যারিস রোডে ফারুক ভাই আমার কাঁধে হাত রেখে হাঁটতে হাঁটতে গান গায়-‘তারারাও যত আলোকবর্ষ দূরে/ তারও দূরে/ তুমি আর আমি যাই ক্রমে সরে সরে।’
তখন আমাদের মন ও শরীর বহুধা বিখণ্ড হয়ে এখানে ওখানে পড়ে থাকে; লাইব্রেরিতে, প্যারিস রোডে, মন্নুজানে, রোকেয়া হলের মাঠে, রেললাইনে, পদ্মায় আমাদের মনের ভগ্নাংশসমূহকে ছিটিয়ে রাখি। বস্তুত, আমাদের একজন আমি একই সঙ্গে একা আমি ও অনেক আমিতে পরিণত হয় এবং আমাদের প্রত্যেকের ব্যক্তিগত আনন্দ ও বেদনাও অনেক আমির আনন্দ ও বেদনা পরিগ্রহ করে। তখন মনে হয়, আমাদের ধারণক্ষমতা কিছুটা শিল্পমাত্রা পায়; আমি রাত জেগে একটা কবিতা লিখে শফিক ভাইকে শুনাই-‘আকাশ যতই দূরে থাক/ জানলা খুললেই / ঘরে আসে চাঁদ/ সমুদ্র যত দূরেই হোক/ দুঃখ পেলেই পাবে/ নোনাজলের স্বাদ।’ শুনে শফিক ভাই উচ্ছ্বসিত হয়, বলেÑতোর হবে, ল্যাখ ল্যাখ, বেশি বেশি ল্যাখ। একটু পরে আমিও একটা গল্প লেখছি বলে শফিক ভাই আমাকে বলে-শুনবি? আমীর আলীর থ্রি নট সেভেনে বসে যখন শফিক ভাই গল্পটি পড়ে শোনায়, তার স্বর ও মুখাবয়ব এমন হার্দ্য মমতাগ্রস্ত হয়ে থাকে যে, প্রথম শ্রোতা হিসেবে ‘পাগল অথবা প্রত্যাশিত মৃত্যু’ গল্পটি আমাকে একই সঙ্গে খুব আনন্দ ও ঈর্ষায় ডুবায়। আমার নিজের ব্যর্থতা আমাকে বিপন্ন করে, ভাবি একটি গল্প বা কবিতা মূলত কতটা ভাল হতে পারে তা বিচারের হয়তো কোন মাপকাঠি নাই, কিন্তু আমাকে আরও কত ভাল লিখতে হবে ভেবে শফিক ভাইয়ের দিকে নিস্পৃহভাবে তাকাই, আমার তাকানোর সেই ভঙ্গি হয়তো শফিক ভাইকেও স্নেহার্দ্র করে, তখন মারুফ রায়হানের সম্পাদিত ‘মাটি’ পত্রিকার একটা সংখ্যা আমার হাতে দিয়ে বলে-এইটা ভাল করে পড়, তারপর কেমন লাগছে বলবি। আমি পত্রিকা নিয়ে শাহ মখদুমের দুশো এগারো নম্বরে আমার রুমে ফিরে একটা ঘোরের মধ্যে নিপতিত হই, ‘মাটি’র প্রতিটি পাতা আমাকে বিমূঢ় ও স্থবির করে দেয়। এই প্রথম আমার মনে হয় যে আমাকেও গল্প লিখতে হবে। যার নামও কখনও শুনি নাই এরকম একজন শহীদুল জহিরের ‘আমাদের কুটির শিল্পের ইতিহাস’ পড়ে সেই দুপুরবেলা আমার স্নান হয় না, খাওয়া হয় না, ঘুম হয় না; দু হাত-পা ছেড়ে দিয়ে বিছানায় শুয়ে থাকা ছাড়া আমার আর কিছু করার থাকে না; দক্ষিণ মৈশুন্দির তরমুজঅলার গল্প আমাকে শয্যাশায়ী করে দেয়। শফিক ভাই সন্ধ্যেয় দুশো এগারোয় এসে আমাকে ওভাবে শুয়ে থাকতে দেখে অস্থির হয়; ভাবে -আবার কোন অসুখ বাঁধালাম কি না! ম্রিয়মান জ্যোৎস্নার সেই শীতসন্ধ্যায় আমীর আলীর মাঠে ব্যাডমিন্টন কোর্টের উল্টোপিঠে আমার জন্য আরও বিস্ময় অপেক্ষা করে। শফিক ভাইয়ের সঙ্গে যখন শাহ মখদুম থেকে নেমে সুলতান চাচার কাগজ বিতানের সামনে ইলেকট্রিক পোস্টের বেদির কাছে এসে দাঁড়াই তখন কালো, ক্ষীণাঙ্গ এক আটপৌরে যুবক আমার মুঠোর মধ্যে শক্ত মুঠো প্রবেশ করিয়ে একবার আকাশের দিকে তাকায়, তারপর মুঠো থেকে হাতটা বের করে নিয়ে কাঁধে রেখে মৃদু করে বলে-শামীম নওরোজ; আমি বিমূঢ় উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ি।
একদিন শামীম নওরোজ আমাকে বলে- মনি, চল তো মাদ্রাসা মোড়ে যাই। শফিক ভাই, ফারুক ভাইও আছে; সঙ্গে আরও দুজন, কুমার দীপ ও আকতার আরণ্যক। কুমার দীপের সঙ্গে আমার পরিচয় হয় তার একটা লেখার সূত্রে। ভোরের কাগজ-এর পাঠক ফোরামে তার ‘ধানের গুচ্ছে আগুন লেগেছে’ লেখাটি পড়ে এসএম হলের একশ ছাব্বিশ নম্বর রুমে আমি তাকে আবিষ্কার করি। আকতার আরণ্যকের সঙ্গে সেদিনই প্রথম দেখা হয়। ফারুক ভাই আকতার আরণ্যককে দেখিয়ে বলে -পোলায় ঝিনেদার কবি, সুনীল সোনার বন্ধু। সুনীল সোনার নাম অবশ্য ততদিনে শামীম নওরোজের কাছে বার কয়েক শোনা হয়েছে তবে তার কোন কবিতা তখনও পড়া হয় নি; কিন্তু ফারুক ভাই সুনীল সোনা নামটা এমনভাবে উচ্চারণ করে, শুনে আমরা সবাই খুব মজা পাই। তারপর জোহার কবর ডানে রেখে প্যারিস রোড, কাজলা দিয়ে হেঁটে হেঁটে মাদ্রাসা মোড়ে একটা শাদা দোতলা বাড়ীর গেইটে এসে দাঁড়াই। তখনও জানি না, এই গেইট খুলে গেলে যখন এর ভেতরে প্রথম পা’টি আমি রাখব, সেই খুব নৈমিত্তিক পদক্ষেপ আমাকে মূলত এক পৃথিবী থেকে অন্য একটা পৃথিবীর নাগরিক করে দেবে। ভেতরে প্রবেশ করে এক একটা সিঁড়ি পেরিয়ে আমরা দোতলায় উঠে যাই। খুব সাধারণ একটা বসার ঘরে, বস্তুত অন্য একটা পৃথিবীতে শহীদ ইকবাল আমাদের স্বাগত জানান; বলেনÑ আ রে লেখকের দল! তোরা সব কোত্থেকে বের হইলি? সেই যে পত্রিকা রেখে চইলা গেলি তোদের আর পাত্তা নাই! শুনে শামীম নওরোজ হাসে, শফিক ভাই, ফারুক ভাই কোন কথা বলে না। শহীদ ইকবাল উঠে গিয়ে অন্যঘর থেকে কিছু পত্রিকা আসেন। বান্ডিল খোলা হলে আমি দেখি খুব ছোট একটি পত্রিকা, আর্টপেপারের উল্টোদিকে খসখসে পাতায় একখানা ছোট পায়ের ছাপ, সুখতলীর ফাঁকা অংশে হাত দিয়ে লেখা, ‘সেইসব শেয়ালেরা যারা ঠোঁট চেটে কিছুই হচ্ছে না রব তোলে তাদেরকে চি‎হ্ন থেকে দূরে থাকতে বলা হচ্ছে’; পত্রিকার নাম চি‎হ্ন। তখনও জানি না, এই ছোটকাগজটির সঙ্গে ভবিষ্যতে আমার কী সম্পর্ক হবে, কিন্তু শহীদ ইকবাল একটা চি‎হ্ন আমার হাতে দিয়ে তাতে লিখে দেন-‘স্নেহভাজনেষু, তোমার নেতৃত্বে চি‎‎হ্ন প্রতিষ্ঠা পাক’; কিন্তু আমার মধ্যে নেতৃত্ব-সম্ভাবনার এই জায়গাটুকু রেখে দিয়ে নেতৃত্ব বলি বা প্রতিপালন, এক অর্থে তাই দিয়ে চি‎হ্নকে তিল তিল করে বড় করে তুলে যুগান্তরে পৌছে দেবার কাজটি মূলত তিনিই করেন; দিনের পর দিন নিজের কাছ থেকে, পরিবারের কাছ থেকে, কর্মস্থল থেকে সময় চুরি করে চি‎হ্নকে দেন, চি‎হ্নকর্মীদের মধ্যে বিনিয়োগ করেন তাঁর ভালবাসা, শ্রম ও মেধা। ফলে চি‎হ্নকর্মীরাও প্রত্যেকে এক একজন সত্য ও প্রগতির পথে হেঁটে তাদের মনের মধ্যেও বপন করতে পারে উজ্জ্বল আগামী কালের স্বপ্ন। তাঁর প্রভাষণে প্রণোদিত হয়ে কবিতায়, গল্পে, প্রবন্ধে চি‎‎হ্ন্কর্মীদের কেউ কেউ উজ্জ্বল প্রতিভার স্বাক্ষর রাখতে শুরু করে। অবশ্য আমাদের রহমান রাজুকেও মনে রাখতে হয়; উদ্যম, স্পৃহা ও নিষ্ঠা রহমান রাজুর স্বভাবের সঙ্গে একাকার হয়ে থাকে। তার সঙ্গে আনুষ্ঠানিক পরিচয় আমার কোনদিনই হয় নাই; হিল্লা নামের তার লেখা একটা গল্প পড়ে রহমান রাজু নামের সাথে আমার মানসিক পরিচয়ের সূত্রপাত। তারপর চি‎েহ্ন, ক্যাম্পাসে তার সঙ্গে মিশে, কথা বলে সম্পর্কের নৈকট্য ক্রমে আরও ঘনিষ্ট হয়। চি‎হ্নর বেড়ে উঠার এই দিনসমূহে শহীদ ইকবাল যদি এই সপ্রাণ চি‎হ্নকর্মীকে পাশে না পেতেন তাহলে চি‎হ্নর ধারাবাহিকতা, গতি ও তেজ যেভাবে সচল তা পূর্বাপর একই থাকত কি না সেই দ্বিধা কেউ পোষণ করলে তাকে নাকচ করা যাবে না। শহীদ ইকবাল একদিন আমার নেতৃত্বে চি‎হ্ন-প্রতিষ্ঠার যে আশাবাদ ব্যক্ত করেন, বলা দরকার, রহমান রাজু সেই বিকল্প হিসেবে আবির্ভূত হন। আর আমার ক্ষেত্রে আকাক্সাটি মাঠে মারা যায় না বটে, তবে যেটুকু পূরণ হয় তা হল, চি‎হ্ন থেকে আমাকে বিযুক্ত করা কঠিন হয়ে পড়ে। তাহলে চি‎হ্ন কি আমার সত্তার অংশ?-এই প্রশ্ন করা হলে আমি নির্দ্বিধায় বলতে পারি, হ্যাঁ; অথবা সত্তা বলতে যা বোঝায়, অর্থাৎ বাংলাদেশের একজন নামমাত্র কৃষকপুত্রের, যাদের বাড়ীতে একখানা বইমাত্র নাই, টেলিভিশন নাই, একখানা পুরোনো দৈনিক পত্রিকা পর্যন্ত নাই, যে পুরো পরিবারকে দুবেলা দুমুঠো খাবারের জন্য দিনাতিপাত করতে হয়, যাদের কেউ গলাছেড়ে একখানা গান গাইবার অবসরটুকু পায় না বা পেলেও সেই আগ্রহটুকু হারিয়ে ফেলে বাস্তবতার যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে বা গান গাওয়াও যাদের কাছে বিলাসিতা, এরকম সংস্কৃতিমুক্ত পরিবারের একজন ভবঘুরে ছেলের সত্তা বলতে যা বোঝায়, তার বেশির ভাগ অংশই হয়তো গড়ে দেয় চি‎হ্ন; চি‎হ্নর রবিবারের আড্ডাঘরে বসে থেকে এক ভবঘুরে কৃষকপুত্র শিল্পের সূত্র শেখে। আমি যখন চি‎হ্নবন্ধুদের সঙ্গে কবিতা নিয়ে, গল্প নিয়ে, উপন্যাস নিয়ে কথা বলি, মাঝে মাঝে আমার নিজেরই বিশ্বাস হতে চায় না। দ্বিধাগ্রস্ত মনে ভাবি, এসব কি বাস্তবজগতে ঘটে চলে না কি আমি একট প্রপঞ্চের মধ্যে হাবুডুবু খাই! আমার ভাবনাজগতে যেভাবে একটা কবিতা বা একটা গল্প বা একটা উপন্যাস বা এমনকি একটা গান আবাস গড়ে নেয়, সেখানে চি‎হ্নবন্ধুদের একটা ভূমিকা আছে; তাদের এক একজন যেন একটা দুর্লভ বই, তাদের পাঠ করে জীবন যাপনা যে কী মাত্রার বৈচিত্র্যপূর্ণ হতে পারে আমি গোপনে সেই বৈচিত্র্য উপভোগ করি। যা কখনও জানি নাই, শুনি নাই চি‎হ্নবন্ধুদের কাছ থেকে তা জেনে শুনে আমি শুধু অবাক হই; বুঝি, এদের কাছে আমার এখনও অনেক শেখবার আছে।
শামীম নওরোজের কবিতার মুগ্ধ পাঠক হতে আমার খুব বেশি সময় লাগে নাই; তার সঙ্গে কথা বলে, জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ সময়ে তাদের সঙ্গে থেকে এই লাভ হয়, আমার ‘দুঃখিত ভারতবর্ষ, দুঃখিত বাংলাদেশ...আমার চোখের সামনে দাউ দাউ পুড়ে যাচ্ছিল ছেলেটির হৃদয়/ আমি তখন মা দুর্গার নামে হোলি খেলছিলাম’ ভাল লাগে। শাহ মখদুমের দুশো এগারোয় আমি একা একা বেসুরে রবীন্দ্রনাথের গানে গলা ছেড়ে দিই, কারণে অকারণে গেয়ে উঠি-তাই তোমার আনন্দ আমার পর/ তুমি তাই এসেছ নীচে/ আমায় নইলে ত্রিভুবনেশ্বর/ তোমার প্রেম হত যে মিছে।’ কুমার দীপদা শাহ মখদুমে আমার হলমেট। যখন তখন পেপারস্ রুমে, অডিটরিয়াম হলে টেলিভিশনের খবরে তার সঙ্গে দেখা হয়। কুমার দীপের নরম কথাবার্তা পরিচয়ের শুরু থেকেই আমাকে মুগ্ধ করে রাখে। তার রচিত কবিতার পেলব দীর্ঘ লয় পড়ার জন্য আরামদায়ক। আমি হয়তো তার কাছে আরও বেশি চাই, তাকে বলি সেসব। কখনও আমার চাওয়ার সঙ্গে দীপদার মত মেলে কখনও মেলে না তবুও যখন দেখি দীপদা আমার মতামতকে খুব সিরিয়াসলি গ্রহণ করতে চায় তখন আমার অবাক লাগে; মনে মনে বলি, কোথাকার কে আমি, নিজের কাছে নিজেই যে অনেকখানি দ্বিধাগ্রস্ত, তাকে এত গুরুত্ব দেবার কিছু নেই দীপদা! দীপদার মত আন্তুরিকতার সম্মোহনের জোরেই আমি মিশে যেতে পারি তুহিন ওয়াদুদের সঙ্গে। নবাব আব্দুল লতিফের তিনশ ছাপ্পান্নোর বাসিন্দা তুহিন ওয়াদুদ নবাব আব্দুল লতিফের ফোনবুথ থেকে শাহ মখদুমের ফোনবুথে ফোন করে দুশো এগারোর জনৈক সৈকত আরেফিনকে চায়, তখন শাহ মখদুমের অডিটরিয়ামের মাইকে ঘোষণা হয়-দুইশ এগারো, সৈকত ভাই, আপনার ফোন আইছে; আমি নিশ্চিত বুঝে যাই যে, ফোন রিসিভ করলে ফোনের ওপাশে কে কথা বলবে। ফোন তুলেই আমি বলি, হ্যাঁ তুহিন ভাই বলেন; তুহিন ভাই হা হা করে হাসে, এমন প্রাণপ্রাচুর্যে ভরা হাসি, শুনে আমার মন ভাল হয়ে যায়। তখন ফোন ছেড়ে একশ গজ হেঁটে নবাব আব্দূল লতিফের দিকে যাই। রফিকের টি-স্টলে বসে এক কাপ চা খেতে খেতে এটা সেটা বলার ফাঁকে আমরা চি‎হ্ন নিয়ে কথা বলি। এভাবে আমাদের ব্যক্তিগত আনন্দে ও তুচ্ছ কথাবাতার মধ্যেও চি‎‎হ্ন খুব প্রিয় একটা জায়গা নিয়ে সমুস্থিত হয়। শুরুর দিকের কিছুদিন বাদে পরবর্তী চার বছর প্রায় প্রতিটি মুহূর্ত চি‎হ্নর সঙ্গে থেকে আমার এই উপলব্ধি হয় যে, মানুষের চেয়ে বড় অনুধ্যান আর কিছু হতে পারে না। একদিন শফিক আশরাফের পিছু পিছু বুধপাড়ার সুইপার কলোনী ঘুরে, পদ্মা নদী ঘুরে শামীম নওরোজ, শফিক আশরাফ, ফারুক আকন্দের সঙ্গে মাদ্রাসা মোড়ের একটা শাদা দোতলা বাড়ীর খুব সাধারণ একটা বসার ঘরে শহীদ ইকবালের মুখোমুখি বসেছিলাম, সেদিনই আমার মনে হয়েছিল, এই মানুষগুলো অন্যরকম, মানুষগুলোকে পাঠ করা যেতে পারে; আমি প্রাণপনে এঁদের সঙ্গে থাকতে চেয়েছিলাম আর তখন শহীদ ইকবাল ছোট একখানা পায়ের ছাপঅলা চিহ্নের মলাট উল্টে, ভেতর পাতায় লিখে দেন-স্নেহভাজনেষু...


(চলবে)

নিদ্রা

এই তো আমি আছি, সত্তার জলে ডুব দিয়ে-
বলব না আমাকে ভাসাও
যত জল বাড়ে, আমারও বাড়ে সহ্যের সীমা
তখনও নিঃসঙ্গতা ভাল
অনেক ক্লান্তির পরে খুব ঘুম পেয়ে যায়
হাওয়া, আমাকে জাগাও
টুকরো টুকরো আলো
চোখের পাতায় এসে হুটোপুটি হোক
তুমুল নিঃসঙ্গতার দিনে

আমি তোমাকে দেখি...

বুধবার, ৮ ডিসেম্বর, ২০১০

আমরা, আমাদের সময়

সৈকত আরেফিন


যে সমুদ্র সবচেয়ে সুন্দর তা আজও আমরা দেখি নি
সবচেয়ে সুন্দর দিনগুলি আজও আমরা পাই নি
মধুরতম যে কথা আমি বলতে চাই
তা আজও আমি বলি নি।
-নাজিম হিকমত


শিল্প হল সৃষ্টি, পরিবর্তন ও সীমাহীনতার মুখপাত্র

রাজশাহীর রোদে ঘুরে ঘুরে শরীর তামাটে করে ফেলার দিনগুলোতে ফিরে গেলে, হেমন্তের ধানখেতের মত লেপ্টে থাকা পদ্মা নদী, দিগন্তে অবতরণশীল আকাশ, আকাশের গায়ে ছবির মত আটকে থাকা শাদা মেঘ ও গোধূলীর হরিদ্রাভা আমাদের চোখের সামনে দৃশ্যত এক অপার্থিব নৈসর্গকে অবমোচন করে। সেসব রোদ্দুর দিনে বিশ্ববিদ্যালয়ে, প্যারিস রোডে গগণশিরিষের ফাঁকে ফাঁকে রোদ ঢুকে পড়া আলো-ছায়ার খেলা দেখতে দেখতে আমরা দল বেঁধে চিহ্নআড্ডা করতে শহীদুল্লাহর ১৩০-এ যাই। শহীদুল্লাহর ১৩০ আমাদের তীর্থস্থান। এখান থেকেই আমরা শিখি, কিভাবে সতীর্থের সুখে ও শোকে নিজেকে মেলাতে হয়, বিলাতে হয়; অসংবৃত ভাবনাসমূহকে ঐক্যে বেঁধে একটি আপাত তুচ্ছ সরলরেখা হতে আমরা শিখেছিলাম এই আড্ডায় বাক্যরচনা করে; ভয় ও ভয়হীনতার সূত্রকে অগ্রাহ্য করে চি‎হ্ন আড্ডায় নুতনরকমের জলবায়ু প্রচালনা করতে পেরেছিলাম রবিবারের সন্ধ্যায়। তখন ১৩০-এর বাইরে, ক্যাম্পাসের রাস্তায়, কাজলায়, ইবলিশে, লাভ স্কয়ারে, রোকেয়ায়, তাপসীর মাঠে মিউনিসিপ্যালিটির ইলেকট্রিক আলো জ্বলে ওঠে; ১৩০-এও পর্দাটা তুলে দিয়ে আমরাও আলো জ্বালি; আসলে আমরা আলো জ্বালি দুটো, একটা ঘরে শাদা টিউব, অন্যটা আমাদের ভেতরে, যেখানে অন্ধকার মধ্যরাত হয়ে ছিল, সেখানে আমরা সবাই এক একটা ছোট পিলসুজ-দীপ জ্বালিয়ে দিয়ে ইকবাল স্যারের কথা শুনি। শুনি আর ভাবি, তাহলে চিলেকোঠার ওসমানের মানসিক একাকীত্বের দায় কিভাবে সামাজিক মানুষ এড়াতে পারে! কিভাবে ভারতবর্ষীয় কবি নজরুল ইসলাম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জাতীয় কবির অভিধায় অভিসিক্ত হয়! উত্তর আধুনিক ব্যাপারটা আসলে কী! ধীরে, কিন্তু একাগ্রতায় ক্রমে আমরা একটা বিন্দু আঁকতে করতে পারি, যেখান থেকে ভবিষ্যতে একটা বৃত্ত রচিত হবার সম্ভাবনা রাখে। এভাবে চি‎হ্নকে ঘিরে, ১৩০, শহীদুল্লাহ কলাভবনের একটি অপরিসর ঘরের আলো আঁধারীতে বসে একদিন আমরা নিজেদেরকে অনাগত কালের জন্য প্রস্তুত করছিলাম; হয়তো তখনও আমরা জানতাম না, আমাদের সে প্রস্তুতিতে মূলত কী কী দুর্বলতা থেকে গেল। কিন্তু আমরা এও জানতাম না যে, দুর্বলতাই একধরনের সম্ভাবনা, যা শিল্পকে উসকে দেয়, পরিবর্তন ও সীমাহীনতার অনেকগুলো পথ এক সঙ্গে উন্মোচিত করে। আমরা সম্ভবত সেই দুর্বলতার সৃষ্টি।

বলা বাহুল্য, আমরা ছোটকাগজ চি‎হ্ন( সময়ের বিরুদ্ধস্রোতে উজানের টানে) ও চি‎হ্নআড্ডার অপক্ব উত্তরাধিকার।

০১.
অনপনেয় যে আকাক্সা একটি কবিতার বা একটি গল্পের বা একটি উপন্যাসের পেছনে আমাদের ক্রমাগত তাড়িত করে, যা কিছু অনাঘ্রাত সুন্দর ও মহান, দূরধিগম্য সেই শাদা উপত্যকার সন্ধানে যে অন্তর্প্রণোদনায় আমরা আমাদের সুন্দরতর সময়সমূহকে বিনিয়োগ করি, সম্ভবত সেই আকাঙ্ক্ষাটি শিল্পের, সৃষ্টির এবং উদযাপনের। তাৎক্ষণিকভাবে উদযাপন শব্দটির বিষয়ে আপত্তি উত্থাপিত হতে পারে। কিন্তু মনে হয়, এ বিরুদ্ধযুক্তির একটা যথাযোগ্য উত্তর অনেক আগেই তৈরি হয়ে আছে। শিল্পের জন্য শিল্পের বা মানুষের জন্য শিল্পের আপাত মীমাংসিত প্রসঙ্গে আমাদের কথা বলার তাই বেশি প্রয়োজন নেই; কেননা উদযাপনের সূত্রেই ধারণা করা যায় একদিন রচিত হয়েছিল শিলালিপি, দেয়াললিখন ও আরও পরে কাগজ বানাতে শেখার পর মানুষ শিখে নিয়েছিল হায়ারোগ্লিফিকস; অর্থাৎ মানুষ নিজেদের প্রকাশ করতে শুরু করেছিল। বীরত্ব ও মহত্ব প্রকাশের ভেতর যে আনন্দ, তা যে একবার পায়, তার জন্য শুধু ধারাবাহিক প্রকাশনার পথটিই খোলা থাকে। সেই অনিবার্য উন্মোচনের খোলা দরজা দিয়ে সমুত্থিত হয়ে কালে আমরা নিজেদের জন্য বই বানিয়েছি, পত্রিকা বানিয়েছি। এই গল্প পুরনো। আমরা প্রবেশ করেছি নুতন কালে, সময়গ্রন্থির এই ধারাস্রোতে মুঠোফোন ও ইন্টারনেটে টালমাটাল এক অস্থির প্রতিবেশে যেখানে শিল্প ও শিল্পি পরস্পরের কাছে যাবার পথটি ক্রমে হারিয়ে ফেলে। অর্থাৎ শিল্পি যেপ্রকার নিবেদিত হলে শিল্পও অনায়াসে সমর্পিত হয়, সেপ্রকারের নিবেদনের সময় হয়তো আমরা পার হয়ে যাচ্ছি। কিন্তু বাংলাদেশের রাজশাহী শহরের দাবদাহে, শীতে, রোদ ও বৃষ্টির যৌথ বিলোড়নে একদিন চি‎হ্নআড্ডা ঘরে যখন আমরা আমাদের বিচ্ছিন্ন, এলোমেলো, উদ্ভিন্ন চেতনা ও অনুভূতিসমূহকে অনুবাদ করি, তখনও পৃথিবী অনেক বড় ছিল; পত্র রচনার শেষ বছরগুলোতে তখনও আমরা খামবদ্ধ এক টুকরো কাগজের জন্য প্রতীক্ষা করি; মাঝে মাঝে এই প্রতীক্ষার অবসান হলে সেই এক টুকরো তুচ্ছ কাগজ মহার্ঘ্য হয়ে ওঠে, তার প্রতিটি শব্দের অন্তর্তলে লুকোনো আনন্দ ও বেদনার সঙ্গে আমাদের যথাযোগ্য পরিচয় হয়। কিন্তু সত্যি বলতে, চি‎হ্নআড্ডা ঘরে, সম্মিলনে, কথা বলে, ছোটকাগজ নিয়ে আমাদের মনে মনে যে প্রতীক্ষা তা কখনো শেষ হয় না। যেমন, কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, ছোটগল্প বিবিধ বিষয়ে ছকবদ্ধ নির্দিষ্ট ও পরিমিত সংজ্ঞার সঙ্গে আমাদের বোধের একটা মিথষ্ক্রিয়া হয়, কিন্তু ছোটকাগজের কোন নির্দিষ্ট সংজ্ঞার সঙ্গে আমাদের দেখা সাক্ষাৎ হয় না। নামের সঙ্গে ছোট ব্যাপারটি থাকায় আমরা বুঝি, এটা আকারে ছোট হবে, কিন্তু আকারে ছোট যে কোন ধরনের সাহিত্য প্রকাশনাই যে ছোটকাগজ নয়, এটাও আমাদের জানা থাকে; আমরা নিজেরা ছোটকাগজের এক একটা সংজ্ঞা দিয়ে এক একজন আরিস্ততলের ভূমিকায় অবতীর্ণ হই। তখন যেপ্রকারে পরিপ্লুত রক্ত ও শুদ্ধ ঘামের বিনিয়োগে আমরা চি‎হ্নর প্রতিটি অর লিখি; কারো কাছে দায় না রেখে, কারো চোখ রাঙানিকে তোয়াক্কা না করে, অবিবেচনা করে, আমাদের মনে বুদ্বুদের মত ফুটতে থাকা অসামাজিক কথাগুলোকে অকপটে দুই মলাটে বন্দি করি, এতে করে মনে হয়, চি‎হ্ন একটি ছোটকাগজের অহং নিয়ে স্ফূরিত হতে সম হতে থাকে।

হাওয়ার ঘনত্ব দেখে বোঝা যায় মেঘের দূরত্ব

চি‎‎হ্ন নিয়ে একধরনের উল্লম্ফন হয়তো ছিল, কিন্তু বোধের অনায়তনতাকে আমরা কখনো অস্বীকার করি নি। চি‎হ্নর অপ্রশস্থ আড্ডা ঘরের চারদেয়ালে শেখা বিদ্যেবুদ্ধি আমাদের সংকুচিত করে রাখে। ঢাকায় আজিজ মার্কেটের গলি ঘুঁজিতে যারা বড় বড় চুল রেখে কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে ঘুরে বেড়ায়, বৃক্ষসমেত সিগারেট টানে, দোতলার টয়লেটে উদাস হয়ে পেচ্ছাপ করে, সন্ধ্যার আলো-আঁধারীতে তারাও এক জায়গায় জড়ো হয়ে সাহিত্য, সংস্কৃতি, মিডিয়া, সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি সবকিছু নিয়ে কথা বলতে গিয়ে তারা হয়তো বলে যে, বাংলাদেশে একটিও ছোটকাগজ নেই। আবার কেউ এধরনের একতরফা মন্তব্যকে স্টান্টবাজি বলে উড়িয়ে দিতে চায়। এইসব প্রগলভতা ঢাকা শহরের উঁচু উঁচু দালান-কোঠার ফাঁক ফোকর দিয়ে বাতাসে ভাসতে ভাসতে দেশময় হয়ে যায়, রাজশাহীতে পৌঁছতে দেরি হলেও একসময় ঠিকই আমরা জানতে পারি যে, ছোটকাগজ ব্যাপারটি মূলত একটা ইল্যুশন। প্রথম প্রথম শাহবাগের এই নার্সিসাসদের কথাবার্তা জেনে বিভ্রান্তির জালে আমরা জড়িয়ে যেতাম। ধীরে, চি‎‎হ্ন আড্ডায় মন সমর্পন করে ক্রমে ছোটকাগজ বিষয়ে বোধের আপাত ঐক্যে পৌঁছতে পেরেছিলাম যে, একটা দৈন্যদশাগ্রস্ত সাহিত্য পত্রিকাই ছোটকাগজ নয়। কাগজের অমসৃণ পাতায় প্রচ্ছদ, লেটার প্রিন্টে ছাপা, দুর্বল রঙ কোনকিছুই একটা সাহিত্য পত্রিকাকে ছোটকাগজ বলার জন্য যথাযোগ্য করে না। তবে অমসৃণ পাতার প্রচ্ছদ, লেটার প্রিন্টে ছাপা, দুর্বল রঙ এগুলো একটা সাহিত্য পত্রিকার ছোটকাগজ হয়ে উঠবার ক্ষেত্রে
কোন বাধা নয়। কিন্তু, কমিটেড লেখক ও কমিটেড লেখা নিয়ে একজন অনাপোষী সম্পাদক বা একটি সম্পাদনা পর্ষদ ছোটকাগজের জন্মের নেপথ্যে নিরন্তর ব্যাপৃত না থাকেন তাহলে মুদ্রিত পত্রিকাটি আর যাই হোক ছোটকাগজ হবে না। মূলত, কমিটেড সম্পাদক, সম্পাদনা পর্ষদ, কমিটেড লেখক ও লেখাই সাহিত্য পত্রিকার সঙ্গে ছোটকাগজকে আলাদা করে বিবেচ্য করে তোলে। তখন পত্রিকাটি কম্প্যুটারে না লেটার প্রিন্টে, অফসেট কাগজে না নিউজপ্রিন্টে ছাপা হল সেটা অবাšতর হয়ে যায়। পত্রিকাটির আয়তন নিয়েও আর কোন কথা চলে না। আমরা এভাবে চি‎‎হ্ন আড্ডায় নিজেদের সদ্য লেখা কবিতাটি, গল্পটি পড়তে পড়তে মনন ও চেতনায় সাহিত্যের নুতন একটি স্রোতকে ধারণ করার শ্লাঘা অনুভব করি। তখন ঢাকা শহরের আজিজ মার্কেটের নার্সিসাসরা আর আমাদের বিভ্রাšত করতে পারে না; বরং আমরা তাদের নিয়ে হাসি তামাশা করি এবং যারা জনপ্রিয়তার মোহে, প্রতিষ্ঠানে, দৈনিক পত্রিকার সাময়িকী পাতায়, ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় নিজেদের সুচেতনাকে বন্ধক রেখে শাহবাগের দরদালানে বড় বড় বুলি আওড়ায় তাদেরকেও চি‎হ্নর সূচি থেকে যথাসম্ভব দূরে রাখার জন্য প্রণোদিত হই। চি‎হ্ন আড্ডায় বসে আজ ও আগামীকালের গল্প করতে করতে শিল্প ও সৌন্দর্য বিষয়ে উপলব্ধির সুস্থিতি ও আগ্রহ ক্রমবর্ধিষ্ণু হয়। ফলে আজিজ মার্কেট, কারওয়ান বাজার, ডাইভারসন রোড ঘুরে যে হাওয়া রাজশাহী অব্দি পৌঁছে, সে হাওয়া ঝড়ো হলেও আমাদের আর উড়িয়ে নিতে পারে না, কারণ তখন হাওয়ার ঘনত্ব বুঝে মেঘের দূরত্ব মাপার মন্ত্র আমরা শিখে ফেলি চি‎হ্নর সান্ধ্যকালীন রবিবারে।

(চলবে)