বুধবার, ৮ ডিসেম্বর, ২০১০

আমরা, আমাদের সময়

সৈকত আরেফিন


যে সমুদ্র সবচেয়ে সুন্দর তা আজও আমরা দেখি নি
সবচেয়ে সুন্দর দিনগুলি আজও আমরা পাই নি
মধুরতম যে কথা আমি বলতে চাই
তা আজও আমি বলি নি।
-নাজিম হিকমত


শিল্প হল সৃষ্টি, পরিবর্তন ও সীমাহীনতার মুখপাত্র

রাজশাহীর রোদে ঘুরে ঘুরে শরীর তামাটে করে ফেলার দিনগুলোতে ফিরে গেলে, হেমন্তের ধানখেতের মত লেপ্টে থাকা পদ্মা নদী, দিগন্তে অবতরণশীল আকাশ, আকাশের গায়ে ছবির মত আটকে থাকা শাদা মেঘ ও গোধূলীর হরিদ্রাভা আমাদের চোখের সামনে দৃশ্যত এক অপার্থিব নৈসর্গকে অবমোচন করে। সেসব রোদ্দুর দিনে বিশ্ববিদ্যালয়ে, প্যারিস রোডে গগণশিরিষের ফাঁকে ফাঁকে রোদ ঢুকে পড়া আলো-ছায়ার খেলা দেখতে দেখতে আমরা দল বেঁধে চিহ্নআড্ডা করতে শহীদুল্লাহর ১৩০-এ যাই। শহীদুল্লাহর ১৩০ আমাদের তীর্থস্থান। এখান থেকেই আমরা শিখি, কিভাবে সতীর্থের সুখে ও শোকে নিজেকে মেলাতে হয়, বিলাতে হয়; অসংবৃত ভাবনাসমূহকে ঐক্যে বেঁধে একটি আপাত তুচ্ছ সরলরেখা হতে আমরা শিখেছিলাম এই আড্ডায় বাক্যরচনা করে; ভয় ও ভয়হীনতার সূত্রকে অগ্রাহ্য করে চি‎হ্ন আড্ডায় নুতনরকমের জলবায়ু প্রচালনা করতে পেরেছিলাম রবিবারের সন্ধ্যায়। তখন ১৩০-এর বাইরে, ক্যাম্পাসের রাস্তায়, কাজলায়, ইবলিশে, লাভ স্কয়ারে, রোকেয়ায়, তাপসীর মাঠে মিউনিসিপ্যালিটির ইলেকট্রিক আলো জ্বলে ওঠে; ১৩০-এও পর্দাটা তুলে দিয়ে আমরাও আলো জ্বালি; আসলে আমরা আলো জ্বালি দুটো, একটা ঘরে শাদা টিউব, অন্যটা আমাদের ভেতরে, যেখানে অন্ধকার মধ্যরাত হয়ে ছিল, সেখানে আমরা সবাই এক একটা ছোট পিলসুজ-দীপ জ্বালিয়ে দিয়ে ইকবাল স্যারের কথা শুনি। শুনি আর ভাবি, তাহলে চিলেকোঠার ওসমানের মানসিক একাকীত্বের দায় কিভাবে সামাজিক মানুষ এড়াতে পারে! কিভাবে ভারতবর্ষীয় কবি নজরুল ইসলাম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জাতীয় কবির অভিধায় অভিসিক্ত হয়! উত্তর আধুনিক ব্যাপারটা আসলে কী! ধীরে, কিন্তু একাগ্রতায় ক্রমে আমরা একটা বিন্দু আঁকতে করতে পারি, যেখান থেকে ভবিষ্যতে একটা বৃত্ত রচিত হবার সম্ভাবনা রাখে। এভাবে চি‎হ্নকে ঘিরে, ১৩০, শহীদুল্লাহ কলাভবনের একটি অপরিসর ঘরের আলো আঁধারীতে বসে একদিন আমরা নিজেদেরকে অনাগত কালের জন্য প্রস্তুত করছিলাম; হয়তো তখনও আমরা জানতাম না, আমাদের সে প্রস্তুতিতে মূলত কী কী দুর্বলতা থেকে গেল। কিন্তু আমরা এও জানতাম না যে, দুর্বলতাই একধরনের সম্ভাবনা, যা শিল্পকে উসকে দেয়, পরিবর্তন ও সীমাহীনতার অনেকগুলো পথ এক সঙ্গে উন্মোচিত করে। আমরা সম্ভবত সেই দুর্বলতার সৃষ্টি।

বলা বাহুল্য, আমরা ছোটকাগজ চি‎হ্ন( সময়ের বিরুদ্ধস্রোতে উজানের টানে) ও চি‎হ্নআড্ডার অপক্ব উত্তরাধিকার।

০১.
অনপনেয় যে আকাক্সা একটি কবিতার বা একটি গল্পের বা একটি উপন্যাসের পেছনে আমাদের ক্রমাগত তাড়িত করে, যা কিছু অনাঘ্রাত সুন্দর ও মহান, দূরধিগম্য সেই শাদা উপত্যকার সন্ধানে যে অন্তর্প্রণোদনায় আমরা আমাদের সুন্দরতর সময়সমূহকে বিনিয়োগ করি, সম্ভবত সেই আকাঙ্ক্ষাটি শিল্পের, সৃষ্টির এবং উদযাপনের। তাৎক্ষণিকভাবে উদযাপন শব্দটির বিষয়ে আপত্তি উত্থাপিত হতে পারে। কিন্তু মনে হয়, এ বিরুদ্ধযুক্তির একটা যথাযোগ্য উত্তর অনেক আগেই তৈরি হয়ে আছে। শিল্পের জন্য শিল্পের বা মানুষের জন্য শিল্পের আপাত মীমাংসিত প্রসঙ্গে আমাদের কথা বলার তাই বেশি প্রয়োজন নেই; কেননা উদযাপনের সূত্রেই ধারণা করা যায় একদিন রচিত হয়েছিল শিলালিপি, দেয়াললিখন ও আরও পরে কাগজ বানাতে শেখার পর মানুষ শিখে নিয়েছিল হায়ারোগ্লিফিকস; অর্থাৎ মানুষ নিজেদের প্রকাশ করতে শুরু করেছিল। বীরত্ব ও মহত্ব প্রকাশের ভেতর যে আনন্দ, তা যে একবার পায়, তার জন্য শুধু ধারাবাহিক প্রকাশনার পথটিই খোলা থাকে। সেই অনিবার্য উন্মোচনের খোলা দরজা দিয়ে সমুত্থিত হয়ে কালে আমরা নিজেদের জন্য বই বানিয়েছি, পত্রিকা বানিয়েছি। এই গল্প পুরনো। আমরা প্রবেশ করেছি নুতন কালে, সময়গ্রন্থির এই ধারাস্রোতে মুঠোফোন ও ইন্টারনেটে টালমাটাল এক অস্থির প্রতিবেশে যেখানে শিল্প ও শিল্পি পরস্পরের কাছে যাবার পথটি ক্রমে হারিয়ে ফেলে। অর্থাৎ শিল্পি যেপ্রকার নিবেদিত হলে শিল্পও অনায়াসে সমর্পিত হয়, সেপ্রকারের নিবেদনের সময় হয়তো আমরা পার হয়ে যাচ্ছি। কিন্তু বাংলাদেশের রাজশাহী শহরের দাবদাহে, শীতে, রোদ ও বৃষ্টির যৌথ বিলোড়নে একদিন চি‎হ্নআড্ডা ঘরে যখন আমরা আমাদের বিচ্ছিন্ন, এলোমেলো, উদ্ভিন্ন চেতনা ও অনুভূতিসমূহকে অনুবাদ করি, তখনও পৃথিবী অনেক বড় ছিল; পত্র রচনার শেষ বছরগুলোতে তখনও আমরা খামবদ্ধ এক টুকরো কাগজের জন্য প্রতীক্ষা করি; মাঝে মাঝে এই প্রতীক্ষার অবসান হলে সেই এক টুকরো তুচ্ছ কাগজ মহার্ঘ্য হয়ে ওঠে, তার প্রতিটি শব্দের অন্তর্তলে লুকোনো আনন্দ ও বেদনার সঙ্গে আমাদের যথাযোগ্য পরিচয় হয়। কিন্তু সত্যি বলতে, চি‎হ্নআড্ডা ঘরে, সম্মিলনে, কথা বলে, ছোটকাগজ নিয়ে আমাদের মনে মনে যে প্রতীক্ষা তা কখনো শেষ হয় না। যেমন, কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, ছোটগল্প বিবিধ বিষয়ে ছকবদ্ধ নির্দিষ্ট ও পরিমিত সংজ্ঞার সঙ্গে আমাদের বোধের একটা মিথষ্ক্রিয়া হয়, কিন্তু ছোটকাগজের কোন নির্দিষ্ট সংজ্ঞার সঙ্গে আমাদের দেখা সাক্ষাৎ হয় না। নামের সঙ্গে ছোট ব্যাপারটি থাকায় আমরা বুঝি, এটা আকারে ছোট হবে, কিন্তু আকারে ছোট যে কোন ধরনের সাহিত্য প্রকাশনাই যে ছোটকাগজ নয়, এটাও আমাদের জানা থাকে; আমরা নিজেরা ছোটকাগজের এক একটা সংজ্ঞা দিয়ে এক একজন আরিস্ততলের ভূমিকায় অবতীর্ণ হই। তখন যেপ্রকারে পরিপ্লুত রক্ত ও শুদ্ধ ঘামের বিনিয়োগে আমরা চি‎হ্নর প্রতিটি অর লিখি; কারো কাছে দায় না রেখে, কারো চোখ রাঙানিকে তোয়াক্কা না করে, অবিবেচনা করে, আমাদের মনে বুদ্বুদের মত ফুটতে থাকা অসামাজিক কথাগুলোকে অকপটে দুই মলাটে বন্দি করি, এতে করে মনে হয়, চি‎হ্ন একটি ছোটকাগজের অহং নিয়ে স্ফূরিত হতে সম হতে থাকে।

হাওয়ার ঘনত্ব দেখে বোঝা যায় মেঘের দূরত্ব

চি‎‎হ্ন নিয়ে একধরনের উল্লম্ফন হয়তো ছিল, কিন্তু বোধের অনায়তনতাকে আমরা কখনো অস্বীকার করি নি। চি‎হ্নর অপ্রশস্থ আড্ডা ঘরের চারদেয়ালে শেখা বিদ্যেবুদ্ধি আমাদের সংকুচিত করে রাখে। ঢাকায় আজিজ মার্কেটের গলি ঘুঁজিতে যারা বড় বড় চুল রেখে কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে ঘুরে বেড়ায়, বৃক্ষসমেত সিগারেট টানে, দোতলার টয়লেটে উদাস হয়ে পেচ্ছাপ করে, সন্ধ্যার আলো-আঁধারীতে তারাও এক জায়গায় জড়ো হয়ে সাহিত্য, সংস্কৃতি, মিডিয়া, সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি সবকিছু নিয়ে কথা বলতে গিয়ে তারা হয়তো বলে যে, বাংলাদেশে একটিও ছোটকাগজ নেই। আবার কেউ এধরনের একতরফা মন্তব্যকে স্টান্টবাজি বলে উড়িয়ে দিতে চায়। এইসব প্রগলভতা ঢাকা শহরের উঁচু উঁচু দালান-কোঠার ফাঁক ফোকর দিয়ে বাতাসে ভাসতে ভাসতে দেশময় হয়ে যায়, রাজশাহীতে পৌঁছতে দেরি হলেও একসময় ঠিকই আমরা জানতে পারি যে, ছোটকাগজ ব্যাপারটি মূলত একটা ইল্যুশন। প্রথম প্রথম শাহবাগের এই নার্সিসাসদের কথাবার্তা জেনে বিভ্রান্তির জালে আমরা জড়িয়ে যেতাম। ধীরে, চি‎‎হ্ন আড্ডায় মন সমর্পন করে ক্রমে ছোটকাগজ বিষয়ে বোধের আপাত ঐক্যে পৌঁছতে পেরেছিলাম যে, একটা দৈন্যদশাগ্রস্ত সাহিত্য পত্রিকাই ছোটকাগজ নয়। কাগজের অমসৃণ পাতায় প্রচ্ছদ, লেটার প্রিন্টে ছাপা, দুর্বল রঙ কোনকিছুই একটা সাহিত্য পত্রিকাকে ছোটকাগজ বলার জন্য যথাযোগ্য করে না। তবে অমসৃণ পাতার প্রচ্ছদ, লেটার প্রিন্টে ছাপা, দুর্বল রঙ এগুলো একটা সাহিত্য পত্রিকার ছোটকাগজ হয়ে উঠবার ক্ষেত্রে
কোন বাধা নয়। কিন্তু, কমিটেড লেখক ও কমিটেড লেখা নিয়ে একজন অনাপোষী সম্পাদক বা একটি সম্পাদনা পর্ষদ ছোটকাগজের জন্মের নেপথ্যে নিরন্তর ব্যাপৃত না থাকেন তাহলে মুদ্রিত পত্রিকাটি আর যাই হোক ছোটকাগজ হবে না। মূলত, কমিটেড সম্পাদক, সম্পাদনা পর্ষদ, কমিটেড লেখক ও লেখাই সাহিত্য পত্রিকার সঙ্গে ছোটকাগজকে আলাদা করে বিবেচ্য করে তোলে। তখন পত্রিকাটি কম্প্যুটারে না লেটার প্রিন্টে, অফসেট কাগজে না নিউজপ্রিন্টে ছাপা হল সেটা অবাšতর হয়ে যায়। পত্রিকাটির আয়তন নিয়েও আর কোন কথা চলে না। আমরা এভাবে চি‎‎হ্ন আড্ডায় নিজেদের সদ্য লেখা কবিতাটি, গল্পটি পড়তে পড়তে মনন ও চেতনায় সাহিত্যের নুতন একটি স্রোতকে ধারণ করার শ্লাঘা অনুভব করি। তখন ঢাকা শহরের আজিজ মার্কেটের নার্সিসাসরা আর আমাদের বিভ্রাšত করতে পারে না; বরং আমরা তাদের নিয়ে হাসি তামাশা করি এবং যারা জনপ্রিয়তার মোহে, প্রতিষ্ঠানে, দৈনিক পত্রিকার সাময়িকী পাতায়, ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় নিজেদের সুচেতনাকে বন্ধক রেখে শাহবাগের দরদালানে বড় বড় বুলি আওড়ায় তাদেরকেও চি‎হ্নর সূচি থেকে যথাসম্ভব দূরে রাখার জন্য প্রণোদিত হই। চি‎হ্ন আড্ডায় বসে আজ ও আগামীকালের গল্প করতে করতে শিল্প ও সৌন্দর্য বিষয়ে উপলব্ধির সুস্থিতি ও আগ্রহ ক্রমবর্ধিষ্ণু হয়। ফলে আজিজ মার্কেট, কারওয়ান বাজার, ডাইভারসন রোড ঘুরে যে হাওয়া রাজশাহী অব্দি পৌঁছে, সে হাওয়া ঝড়ো হলেও আমাদের আর উড়িয়ে নিতে পারে না, কারণ তখন হাওয়ার ঘনত্ব বুঝে মেঘের দূরত্ব মাপার মন্ত্র আমরা শিখে ফেলি চি‎হ্নর সান্ধ্যকালীন রবিবারে।

(চলবে)

1 টি মন্তব্য:

  1. খুব পরিপূর্ণ বর্ণনা; স্বপ্নের সাথে বড় বেশী মিল পণনাশুধু স্বপ্নে কোনো ক্রমশ থাকেনা, এখানে রয়েছে পরের আশ্বাস, অপেক্ষা করব এর পর টা পড়তে।

    উত্তরমুছুন